টলিউড

‘স্টুডিয়োগুলোয় মেয়েদের জন্য ধার্য আলাদা কোনও বাথরুম নেই’ – শুধুমাত্র অভিনেতা-অভিনেত্রী হলেই আলাদা বাথরুম নয়তো কোন বাথরুম নেই! কী বলছে টলিউডের টেকনিশিয়ানরা?

অক্ষয় কুমারের টয়লেট সিনেমাটা দেখেছেন নিশ্চয়ই? সে সিনেমার কথাও মনে আছে নিশ্চয়ই? ওই সিনেমায় শৌচালয় যে মানুষের জীবনে ঠিক কতটা প্রয়োজন তার গুরুত্ব বুঝিয়েছিলেন পরিচালক। তবে এই কথা কি আমরা কখনো ভেবে দেখি যে যারা সিনেমা তৈরি করছেন, সিনেমার মাধ্যমে মানুষের কাছে বার্তা পৌঁছে দিচ্ছেন সেই মানুষগুলো ঠিক কোন পরিস্থিতিতে থাকেন? শৌচালয় নিয়ে তাঁদের জীবনটা ঠিক কতটা স্বাভাবিক?

টলিউড হোক বা বলিউড সবেতেই একটা সমস্যা হয়তো রয়েছে। যদিও একটু টলিউডের থেকে বলিউড অনেকাংশেই ঝা চকচকে। কিন্তু শৌচালয় ব্যবস্থা আমাদের টলিউডের ঠিক কেমন? যারা আপনাদের বিনোদন দিচ্ছে তাঁরা ঠিক কিভাবে দিন কাটাচ্ছে তা জানা আছে কি? জানা যায় শুধুমাত্র টালিগঞ্জেই ১০ থেকে ১২ টি স্টুডিও রয়েছে। প্রত্যেকদিন সেখানে তিনটি করে সিরিয়ালের শুটিং চলে। যদিও শুধু ধারাবাহিক বলা ভুল হবে সিনেমা থেকে ওয়েব সিরিজ সব কিছুর শুটিং এই সেট গুলিতেই হয়।

সিরিয়াল হোক সিনেমা কিংবা ওয়েব সিরিজ শুধু অভিনেতা-অভিনেত্রীদেরকে নিয়ে কখনোই পুরোটা সম্পূর্ণ হওয়া সম্ভব নয়। ক্যামেরার পেছনে কাজ করেন প্রচুর টেকনিশিয়ানরা। এই ক্যামেরার পেছনের কাজের সাথে যুক্ত থাকেন প্রায় কয়েকশো মানুষ। তবে জানেন কি স্টুডিও পড়ায় কলা কুশলীদের জন্য আলাদা করে শৌচালয় থাকলেও টেকনিশিয়ানদের জন্য এই শৌচালয়ের সমস্যা খুব বড় আকার ধারণ করেছে। চলুন জেনে নেওয়া যাক বিশেষত টেকনিশিয়ানদের মধ্যে মেয়েদের ঠিক কি সমস্যা হচ্ছে।

চলুন তাহলে আজকে কথা বলে নেওয়া যাক টলিপাড়ার একজন এক্সিকিউটিভ প্রোডিউসার এর সাথে। সৌমি পালিত, টলিপাড়ার একজন এক্সিকিউটিভ প্রডিউসার। বিগত ১৪ বছর ধরে এই পেশার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন তিনি। টলিপাড়ার শৌচালয়ের ব্যবস্থা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘অনেকগুলো বছর কাটিয়ে ফেললাম এই পেশায়। আগের তুলনায় পরিকাঠামো অনেকটাই বদলেছে। বর্তমানে আমরা অনেকটাই স্বাস্থ্যকর পরিবেশে কাজ করি। শিল্পীরা তো আলাদা শৌচালয় পান। মানে তাঁদের মেকআপ রুমের সঙ্গে শৌচালয় থাকে’।

তাঁর আরো সংযোজন, ‘আমরা যাঁরা টেকনিশিয়ান, তাঁদের তো কোনও আলাদা ঘর থাকে না। এখানে যেটা থাকে, তা হল মেয়েদের জন্য বরাদ্দ একটি বাথরুম আর ছেলেদের জন্য থাকে একটি। তবে আমরা মেয়েরা মেকআপ রুমের বাথরুমই বেশির ভাগ সময় ব্যবহার করে থাকি। আসলে টেকনিশিয়ানদের মধ্যে বেশির ভাগ ছেলে তো। তাই আমাদের জন্য আলাদা তেমন কোনও ব্যবস্থা নেই। ফ্লোরে একটা বাথরুম থাকে। সেটা ছেলেরাই ব্যবহার করে থাকে। তাই একটু নোংরা হয়ে থাকে। তবে শিল্পীদের মেকআপ রুম দিনে দু’বার পরিষ্কার করা হয়। সত্যি বলতে, স্টুডিয়োগুলোয় মেয়েদের জন্য ধার্য আলাদা কোনও বাথরুম নেই। মেকআপ রুমের বাথরুম না থাকলে অসুবিধাই হত। বিশেষত ঋতুস্রাবের সময়। তবে তা-ও আগের থেকে পরিকাঠামো কিছুটা হলেও উন্নত হয়েছে’।

টলিপাড়ার আরো একজন এক্সিকিউটিভ প্রোডিউসার তনিমা চট্টোপাধ্যায়। প্রায় সাড়ে চার বছর ধরে এই পেশার সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন তিনি। বর্তমানে একটি নামে প্রযোজনা সংস্থার হয়ে কাজ করেন তনিমা। তিনি রীতিমত অভিযোগ করে বলেন, ‘আমি নিজে শিল্পীদের মেকআপ রুমের বাথরুমই ব্যবহার করে থাকি। কারণ সত্যিই আমাদের জন্য সঠিক পরিকাঠামো নেই। যে বাথরুমটি বরাদ্দ আছে টেকনিশিয়ানদের জন্য, তা দিনে এক বারই পরিষ্কার করা হয়। অন্তত দু’বার যদি পরিষ্কার না করা হয়, তা হলে তা ব্যবহার যোগ্য হয়ে ওঠে না। অনেক সময় বাথরুম এতটাই ছোট হয় যে, নোংরা ফেলার একটি বালতিও রাখা যায় না। ঋতুস্রাবের সময় খুবই অসুবিধা হয়’।

অভিনেত্রী অনুশ্রী দাসের কথায় আগের থেকে এখন এর পরিস্থিতি অনেকটা ভালো হয়েছে। আগে শিল্পীদের মেকাপ রুমেও না থাকতো শৌচালয় আর না থাকতো কোন এসির ব্যবস্থা। দীর্ঘ ৩৬ বছর এই জগতে কাটানোর পরতিনি স্পষ্ট বলেন, ‘এখন আমাদের স্টুডিয়োয় খুব ভাল ব্যবস্থা। বিশেষত করোনা পরিস্থিতির পর থেকে আরও বেশি করে স্বাস্থ্যকর শৌচালয়ের উপর বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে। নিয়মিত পরিষ্কার করা হয়। এ বিষয়ে কোনও অভিযোগ জানাতেই পারব না’।

অন্যদিকে মিতুল অর্থাৎ নবাগতা অভিনেত্রী আরাত্রিকা মাইতি এই বিষয়ে বেশ কিছু কথা জানিয়েছেন। তাঁর অভিনয় জগতে বয়স মাত্র আড়াই বছর। নতুন পরিবর্তিত এই ইন্ডাস্ট্রিতে ই তাঁর অভিনয়ের শুরু। তিনি বলেন শিল্পীদের নিজেদের বাথরুম নিজেদের পরিষ্কার রাখা উচিত। তাঁর কথায়, ‘আমরা সব সময় আলাদা মেকআপ রুম পাই না। হয়তো একটা বাথরুম তিন জন ব্যবহার করি। এ ক্ষেত্রে আমাদেরও দায়িত্ব থাকে, যেন আমরা বাথরুমগুলো পরিচ্ছন্ন রাখি’।

এখনো পর্যন্ত বিশেষত টলি পাড়ার মহিলা টেকনিশিয়ানদের এই সমস্যা মেটেনি। তাহলে এই দায়িত্ব কার? ‘ফেডারেশন অফ সিনে টেকনিশিয়ান্স অ্যান্ড ওয়ার্কার্স অফ ইস্টার্ন ইন্ডিয়া’ র? নাকি মালিকদের? এই প্রসঙ্গে ফেডারেশনের সভাপতি স্বরূপ বিশ্বাস বলেন, ‘কয়েকটা স্টুডিয়ো ছাড়া বাকি সব স্টুডিয়োর বাথরুম ব্যবহারের অযোগ্য। ‘টেকনিশিয়ান স্টুডিয়ো’ বেশ কিছু দিন আগে নতুন ভাবে তৈরি হয়েছে। আরও কিছু স্টুডিয়ো নতুন ভাবে তৈরি করা হচ্ছে। সেগুলো ছাড়া আর কোনও স্টুডিয়োয় টেকনিশিয়ানদের বাথরুম মোটে ব্যবহারযোগ্য নয়। মহিলাদের জন্য আলাদা বাথরুম নেই’।

রীতিমতো স্টুডিওর মালিকদের দোষারোপ করে স্বরূপ বলেছেন, ‘এই পরিকাঠামোর সম্পূর্ণ দায় বর্তায় স্টুডিয়ো মালিকদের উপর, যাঁরা লক্ষ লক্ষ টাকা রোজগার করছেন এই স্টুডিয়োগুলো থেকে। এক বার আমি নিজে উদ্যোগী হয়ে স্টুডিয়ো মালিকদের সঙ্গে মিটিং করেছিলাম। অনুরোধ করেছিলাম, স্বাস্থ্যকর বাথরুম তৈরির জন্য। কেউ কোনও কর্ণপাত করেননি। আমার কাছে মেলও আছে। স্টুডিয়ো মালিকরা চাইলেই বাথরুম ঠিক হয়ে যাবে। ফেডেরেশন থেকে আমরা অনুরোধ করতে পারি, তার থেকে বেশি কিছু করতে পারব না’।

উক্ত প্রসঙ্গে, পার্পল স্টুডিয়োর প্রাক্তন অধিকর্তা প্রীতিময় চক্রবর্তী সাথে একটি বিখ্যাত সংবাদমাধ্যমের তরফে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘বাকি স্টুডিয়োর কথা বলতে পারব না। কিন্তু এই মুহূর্তে পার্পল স্টুডিয়ো সারা দেশের মধ্যে সেরা স্টুডিয়ো। যাঁরা এখানে কাজ করে গিয়েছেন, তাঁদের জিজ্ঞেস করলেও জানতে পারবেন। এক দিকে যেমন টেকনিক্যাল দিক থেকে বাকি সব স্টুডিয়োগুলোর থেকে এগিয়ে, তেমনই এই স্টুডিয়োর বাথরুমও ভীষণ ভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখার চেষ্টা করা হয়। সব সময় নজর দেওয়া হয়। মহিলাদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা আছে। পুরুষদের জন্যও রয়েছে আলাদা বাথরুম। আবার ভিআইপিদের জন্যও সুব্যবস্থা রয়েছে। আমাদের স্টুডিয়োয় অনেক বড় বড় রিয়্যালিটি শোয়ের শুটিং চলে। সুতরাং তেমন ব্যবস্থা না থাকলে নিশ্চয়ই সে সব শুটিং হত না। বাকিদের কথা বলতে পারব না, ‘পার্পল স্টুডিয়ো’ শিল্পীদের পাশাপাশি টেকনিশিয়ানদের কথাও ভাবে’।

টলিপাড়ার অন্যতম একটি স্টুডিও হল ইন্দ্রপুরী। এছাড়াও নিউ থিয়েটার্স, টেকনিশিয়ানের মত স্টুডিওতে প্রায়শই যাতায়াত করেন নামজাদা শিল্পীরা। এই স্টুডিওর মালিক তেজেশ জোশি বলেন, ‘প্রতি দিন পরিষ্কার করা হয় আমাদের স্টুডিয়োর বাথরুম। তবে যাঁরা ব্যবহার করছেন, তাঁদেরকেও পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। তবে ইন্দ্রপুরীকে আমরা নতুন ভাবে সাজানোর চেষ্টা করছি। আমরা চিন্তা করি। অনেক সময় সবটা করে উঠতে পারি না। আমার স্টুডিয়োয় একটা বাথরুম আছে। সেটা সুন্দর ভাবে গড়ে তোলার জন্য তা হলে সেই বাথরুমটা বন্ধ করতে হবে। সেটা যদি এক মাস বন্ধ থাকে, সেই সময়টা টেকনিশিয়ানরা কোন শৌচালয়ে যাবেন? পুরনো স্টুডিয়োয় বিকল্প কোনও ব্যবস্থা নেই। অনেক বাস্তবিক সমস্যা আছে। যা সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা কঠিন। তবে আমাদের মাথায় আছে। ধীরে ধীরে ইন্দ্রপুরীতে কাজ শুরু হয়েছে। আগামী দিনেও সবাইকে ভাল পরিকাঠামো দিতে পারব আশা করছি। সবার জন্য ভাল বাথরুমও তৈরি করব। আমায় একটু সময় দিতে হবে। নিশ্চিত পরবর্তী কালে কারও কোনও অভিযোগ থাকবে না।’

Back to top button

Ad Blocker Detected!

Refresh